AH
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

করতোয়ায় ভয়াবহ নৌকাডুবির এক বছর পূর্ণ হলো আজ

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নৌকা ডুবির ১ বছর পূর্ণ হলো আজ। স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চগড়বাসী এমন ভয়াবহ নৌকাডুবি এর আগে কখনো দেখি নি।

 

 

২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মহালায়ার উৎসব থেকে বাড়ি ফেরার পথে করতোয়ায় নৌকাডুবিতে ৭২ জনের সলিল সমাধি হয়। মৃতদের মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৪৬জন, আটোয়ারীর ২ জন, ঠাকুরগাঁওয়ের ৩ জন, দেবীগঞ্জের ১৯ জন ও পঞ্চগড় সদরের ২ জন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ৩০ জন নারী ও বাকি ২২ জন শিশু।

 

 

প্রতিবছর মহালয়ার দিনে কমপক্ষে ২০ হাজারের বেশি মানুষ আউলিয়া ঘাট থেকে নৌকায় করতোয়া পাড়ি দিয়ে বদেশ্বরী মন্দিরে যান। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর ৩০ জন ধারণ ক্ষমতার একটি নৌকা শতাধিক যাত্রী নিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠান থেকে রওনা দেন। এ সময় নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করলে মাঝি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে কিছু দূর যাওয়ার পর ডুবে যায় নৌকাটি। মুহূর্তেই উৎসব পরিণত হয় শোকে। অনেকেই সাঁতরে তীরে উঠলেও নারী ও শিশুসহ বাকিরা ডুবে যায়।

 

 

 

স্থানীয়রা তৎক্ষণাৎ উদ্ধার অভিযান শুরু করে ২৭ জন কে জীবিত উদ্ধার করে। আহতদের বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করে। সমগ্র উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট প্রায় ৭০ জন জনবল নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে আত্রাই ও পুনর্ভবা নদী থেকেও ভাসমান মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয়দের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের উদ্ধার অভিযানে ৭২ টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

 

 

নৌকাডুবিতে বেঁচে ফেরা দিপু সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা বলেন, “আমরা মহালয়া দেখার জন্য যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর হঠাৎ করে নৌকা দুলতে থাকে। তারপর আমি নিচে পড়ে যাই। কিছুক্ষণ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তারপর সাঁতার কাটলাম। আমি আমার নিজ হাতে তিনটা মরদেহ উদ্ধার করেছি। আরও কয়েকজনকে বাঁচিয়েছি। বেশি লোক নৌকায় নেওয়ায় নৌকাটা ডুবে যায়। ১০০ জনেরও বেশি লোক আমরা নৌকায় ছিলাম।”

 

 

মর্মান্তিক এই নৌকাডুবিতে অনেক শিশু তার বাবা-মাকে হারিয়েছে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, অনেকে স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে দিশেহারা।আবার অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে যেন নির্বাক হয়ে গেছে।

 

বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজী শিকারপুর বটতলী গ্রামের বাসিন্দা হেমন্ত রায় বলেন, “আমাদের কোনও উৎসব নেই, আনন্দ নেই। আমাদের জীবনে কোনোদিন মনে হয় উৎসব ফিরেও আসবে না। স্ত্রী, মেয়ে, ভাইয়ের স্ত্রী, নাতনিদের হারিয়ে আমাদের দুটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে।”

 

 

 

মাড়েয়া বটতলী এলাকার ষাটোর্ধ্ব ননী বালা বলেন, “মহালয়ার পূজা দিতে গিয়ে আমার উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে জগদিশ চন্দ্রকে হারিয়েছি। জগদিশের দুই অবুঝ শিশু স্বন্দীপ আর প্রিয়াংকা অনাথ হয়েছে। নৌকাডুবিতে জগদিশের সঙ্গে থাকা ভাতিজা সেন্টু চন্দ্রও (২৬) মারা গেছে। তাদের কথা মনে হলেই নিজেকে সামলাতে পারি না। অনেক কষ্ট বুকে চেপে অনাথ ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে আছি।”

 

 

 

এদিকে সেই সময় নৌকাডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত পরিবারগুলোকে শেষকৃত্যের জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা করে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবারের প্যাকেট দেয়া হয়। এছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ হতে নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।

 

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিহত প্রতি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা, বিএনপি’র পক্ষ থেকে নৌকাডুবিতে মৃত ৬৯ জনের পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা প্রদান করা হয়।

 

ব্যক্তিগত ভাবে পঞ্চগড় ২ আসনের সংসদ ও রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের পক্ষ থেকে নিহত প্রতিটি পরিবারের মাঝে নগদ ৫ হাজার টাকা, একটি করে শাড়ি ও লুঙ্গি এবং পঞ্চগড় ১ আসনের সংসদ সদস্য মাজাহারুল হক প্রধানের পক্ষ থেকে ২০ টি পরিবারের মাঝে ১০ হাজার টাকার মানবিক সহায়তা প্রদান করেন।

 

এছাড়া বিদ্যান্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৯ পরিবারের সদস্যদের মাঝে ১৫ লক্ষ টাকা এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।

 

 

 

এদিকে নৌকাডুবির কারণ খুঁজতে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায়কে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও পরে আরও তিন কর্মদিবস সময় বৃদ্ধি করা হয়। অক্টোবরের ২ তারিখ তারা প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে নৌকাডুবির কারণ হিসেবে ইজারাদারের গাফিলতি, অদক্ষ মাঝি, কুসংস্কার, ধর্মীয় অনুভূতি, অসচেতনতা, অতিরিক্ত যাত্রী, নৌকায় ত্রুটিসহ বেশি কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

 

 

 

অন্যদিকে নৌযানের আকার ও আকৃতি বিবেচনায় ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন, ইজারা চুক্তি মোতাবেক নিরাপত্তা সামগ্রী ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না রাখা এবং চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করে ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘাট ইজারাদার ও দুইজন মাঝিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে ঐ মামলায় ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার এবং মাঝি বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অপরজন পলাতক রয়েছেন।

 

 

 

এদিকে বছর ঘুরে সামনে আবারো মহালয়ার উৎসব চলে এসেছে। সেতু না থাকায় আবারো নৌকায় করে উৎসবে যোগ দিতে হবে পূন্যার্থীদের। এবার আনুষ্ঠানিকতায় আনা হয়েছে পরিবর্তন। এবিষয়ে বদেশ্বরী মন্দিরের মহালয়া উৎযাপান কমিটির প্রচার বিষয়ক সম্পাদক হরিশ চন্দ্র রায় বলেন, “এবছর আমরা কোন ধরনের প্রচার প্রসার করবো না। কোন পোস্টার ছাপানো হবে না। আয়োজন হবে সীমিত। তবে কোন পূন্যার্থী যদি আসে তবে তাদের পুজা আর্চনার সুযোগ দেয়া হবে। যতদিন পর্যন্ত সেতু নির্মাণ না হবে ততদিন পর্যন্ত সীমিত আকারে মহালয়া উৎযাপান করা হবে।”

 

 

এদিকে গত বছরের ভয়াবহ নৌকাডুবির কথা মাথায় রেখে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম জানান, “আমরা ঘাট ইজারাদার এবং মন্দির কমিটির সাথে কথা বলেছি। নিরাপদে যাতে মানুষ নদী পার হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। এছাড়া নৌকাডুবির মতো ঘটনা যাতে পুনরায় না ঘটে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

 

 

 

নৌকাডুবিতে ৭১ জনের মৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসে জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসন। পঞ্চগড় ২ আসনের সংসদ সদস্য ও রেলপথমন্ত্রী ঘোষণা করেন ২০২২ সালের ডিসেম্বর বা চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে আউলিয়ার ঘাটে সেতু নির্মাণকাজ শুরু হবে। সে অনুযায়ী অক্টোবরে সেতুর নির্মাণস্থল পরিদর্শনে আসে এলজিইডির ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় আউলিয়ার ঘাটে প্রায় ১ হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭ দশমিক ৩২ মিটার প্রস্থের ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ইতোমধ্যে একনেকে পাশ হয়েছে। যার ডিজাইনও চূড়ান্ত হয়েছে।

 

 

 

বোদা এবং দেবীগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী আউলিয়ার ঘাটে দ্রুত সেতু নির্মাণ। আর যেন কোন মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার না হতে হয়। যেন কাউকে স্বামী-সন্তান হারা হতে না হয়। এই প্রত্যাশায় দিন পার করছেন করতোয়া পাড়ের মানুষেরা।

 

 

 

 

ছবি: ফিরোজ আল সাবা

এস.এম/ডিএস

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পঞ্চগড়ে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত 

তাপদাহের কারনে পাইকারি বাজারে বেড়েছে মরিচের দাম

দেবীগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুলে অভিভাবক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় বিএনপির দুই নেতা বহিষ্কার

দেবীগঞ্জে মরিচের বস্তায় ফেনসিডিল পাচারের সময় মাদক ব্যবসায়ী আটক

পরকীয়া সম্পর্ক রাখতে অস্বীকৃতি জানানোয় খুন হন শাহনাজ  

দেবীগঞ্জে যুবদল আহ্বায়কের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার 

দেবীগঞ্জে জুয়া খেলার সরঞ্জামসহ ছয় জুয়াড়ি আটক 

পঞ্চগড় আদালতের নিয়োগে আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

দেবীগঞ্জে দুইশো পিস ট্যাপেন্ডাডল ট্যাবলেটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

১০

দেবীগঞ্জে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়লেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লি

১১

পঞ্চগড়ে ধান ক্ষেতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যুবকের মৃত্যু

১২

দেবীগঞ্জে হিট স্ট্রোকে প্রাইভেট কার চালকের মৃত্যু 

১৩

দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রেস ক্লাবের নতুন কমিটি গঠন

১৪

দেবীগঞ্জে বড় ভাইয়ের আঘাতে ছোট ভাইয়ের মৃত্যু 

১৫

দেবীগঞ্জে নামসর্বস্ব সংগঠনের বিরুদ্ধে সরকারি খাল দখলের অভিযোগ 

১৬

দেবীগঞ্জে আলোচিত সেলিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার

১৭

দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির তিন নেতা

১৮

দেবীগঞ্জে  উপজেলা চেয়ারম্যান পদে পাঁচ জনের মনোনয়নপত্র দাখিল 

১৯

দেবীগঞ্জে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী রাসেল প্রধান

২০