১৯৭১ এর ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের পর মুক্তি পাগল বাঙালী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে। সারাদেশের ন্যায় দেবীগঞ্জ উপজেলাও ছিল উত্তাল। ২ রা মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল যারই ধারাবাহিকতায় ১০ ই মার্চ দেবীগঞ্জে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে একাত্নতা ঘোষনা করে দেবীগঞ্জের তৎকালীন ছাত্র- শিক্ষক ও জনতা।
১০ ই মার্চ পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সকাল ১১ টায় চৌরাস্তা সংলগ্ন তৎকালীন দেবীগঞ্জ রাজস্ব অফিসের সামনে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন এন এন স্কুলের শিক্ষক আব্দুল লতিফ, ছাত্র নেতা আনোয়ারুল হক বাবুল; মোঃ রহিমুল ইসলাম; স্বদেশ চন্দ্র রায়, মনিরুল ইসলাম সহ বেশ কয়েকজন ছাত্র।
তাদের মাঝে ডা. রহিমুল, আনোয়ারুল হক বাবুল এবং স্বদেশ চন্দ্র রায় ছাড়া অধিকাংশ ব্যক্তি মারা গেছেন।
সেদিনের সেই জাতীয় পতাকা উত্তোলনের স্মৃতির কথা জানিয়ে আনোয়ারুল হক বাবুল জানান,"সাত তারিখে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আসলো, আট-নয় তারিখ আমরা প্রস্তুতি নিলাম আর দশ তারিখ সকাল এগার টায় রাজস্ব অফিসের সামনে মরহুম লতিফ স্যার, মরহুম মনিরুল ইসলাম, মরহুম শফিকুল ইসলাম, ডা: রহিমুল ইসলাম, মরহুম মঞ্জুরুল ইসলাম রেজু, মোঃ বাবুয়া, স্বদেশ চন্দ্র রায় সহ আমরা বেশ কয়েকজন পাকিস্থানের পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করি।”
সারাবছর অবহেলা আর অযত্নে থাকে দেবীগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি। অরক্ষিত অবস্থায় থাকতে থাকতে চারদিকে জঙ্গলের সৃষ্টি হয়েছে। দূর থেকে দেখলে যে কারো বোঝার উপায় নেই এটি ময়লার স্তূপ নাকি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কোন স্থান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি সংরক্ষণে স্বাধীনতার ৫১ বছরেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় নি কোন ধরনের ব্যবস্থা। এ নিয়ে ক্ষোপ রয়েছে দেবীগঞ্জে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলনকারীদের মাঝে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বদেশ চন্দ্র রায় জানান, “আমরা এর আগে বহু ইউএনও’র কাছে এই জায়গাটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন করি। কিন্তু সরকারি পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকার অজুহাতে এখানে কোন স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করেনি। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দু:খজনক।”
এর আগে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সারাদেশে ৩৬০ টি স্থানে ১৭৮ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা ব্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ এবং জাদুঘর নির্মাণের তালিকা প্রকাশ করা হয় । সেই তালিকায় পতাকা উত্তোলনের জায়গাটির নাম থাকলেও, এমন একটি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে যার সাথে দেবীগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি জড়িত নেই।
এ বিষয়ে সুশীল সমাজের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে তৈরি হয়েছে দেবীগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব। তাদের দাবি দ্রুত যাতে স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়। দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক সহকারি অধ্যাপক নাসির উদ্দিন চৌধুরী জানান, দেবীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু স্মৃতিবিজরিত স্থান রয়েছে। যার মধ্যে এসিল্যান্ড অফিসের ভিতরে অবস্থিত দেবীগঞ্জে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জায়গাটি অন্যতম। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেবীগঞ্জের যে স্থানটিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে তার সাথে দেবীগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের কোন ইতিহাস জড়িত নেই। আমরা দাবি জানাচ্ছি অতি দ্রুত যাতে এই স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়।”
ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানটি বর্তমানে উপজেলা ভূমি অফিসের সীমানার মধ্যে পড়েছে।
যা রিজার্ভ ল্যান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই এটি সংস্কার এবং সংরক্ষণ করার বিষয়ে উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা উভয়ের মাঝে রয়েছে আলাদা আলাদা অভিমত ।
এ বিষয়ে দেবীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র- আবু বকর সিদ্দিক আবু বলেন, “যদি প্রশাসন বলে থাকে আর দেবীগঞ্জ পৌরসভার রিজার্ভ ল্যান্ডে কাজ করার সুযোগ থাকে তাহলে আমি দেবীগঞ্জের প্রথম যে জায়গাটিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল সে জায়গাটি সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নিব।”
এ বিষয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান- আব্দুল মালেক চিশতি বলেন, “আগামী মহান স্বাধীনতা দিবসের আগেই উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে এডিবির অর্থায়নে সে জায়গাটি সংরক্ষণ করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের চেষ্ঠা করব।”
আর.ডিবিএস