ট্রেন মিস করেছেন?
-হুম ।
সেজন্যই মন খারাপ?
– না ।
তাহলে ?
– এমনিতেই।
হুম বুঝেছি।
এতক্ষণ পাশে বসে থাকা এক অপরিচিতার সাথে কথা হচ্ছিল। হুট করে পাশে এসে বসে একের পর এক জিঙ্গাসা করে যাচ্ছে । মেয়েটার সব প্রশ্নের উত্তর করায় এখন সে চুপচাপ। ট্রেন মিস করেছি। আমার পনেরো কি বিশ হাত সামনে দিয়ে ট্রেন তার আদিবেগ তুলে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল । একটু দৌড়ালেই ট্রেনে উঠা সম্ভব হত। কিন্তু আমার মোটেও ইচ্ছে ছিল না বরং আরো ভালো লাগছে । আর এদিক বৃষ্টি তার চমৎকারী দেখিয়েই চলেছে ক্রমশ । আমি পুরোপুরি ভিজে গেছি । পকেটে নিশ্চল – আধামরা মোবাইল ফোন টা এতক্ষণে বোধহয় চিরতরে দম দিয়ে ফেলেছে । আশপাশ থেকে অনেক হৈচৈ আর বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ যেন এক অজানা ঐকতানের সৃষ্টি । মনে হয় আমার মত অনেকের যাত্রাভঙ্গ হল ।
” আপনার কাগজ তো ভিজে গেল “।
এ কথা শুনে জেগে উঠলাম।
এই মেয়েটার প্রশ্নের জবাব দেয়ার ইচ্ছে মোটেও আমার নেই । তবুও বললাম ;
এটা প্লাস্টিকের ফাইল, ভিজবে না।
মেয়েটি বলল , “আপনি কি পাগল নাকি “?
তার এরকম প্রশ্নে আমি বেশ রেগে গিয়ে বললাম ; আপনি চুপ করবেন ?
এটা বলে তাকাতেই দেখি সে একটা পলিথিন ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে রেখেছে । আমার সম্মুখে এক অপরিচিতার মূর্তির দর্শন হল । বারিবিন্দুর কুয়াশায় কেমন জানি আবছা করে দেখতে পেলাম একজন তরুণী নির্মল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আর চোখজোড়ার ঘন ঘন পলক পড়ছে । বৃষ্টির জোরে মেয়েটার পলক ঘন ঘন পড়লেও আমার চক্ষুপল্লবকে চঞ্চল করতে পারে নি । কষ্ট হলেই সবার গলা ভারি হয়ে যায় । আর আমার তো চোখের পলক পড়তেও বেশ অলসতা বোধ করে ।
কিছু না বলে আমি পলিথিন ব্যাগটা নিয়ে ফাইলটা ভরে নিলাম। মেয়েটিকে বিশেষভাবে দেখার ইচ্ছে আমার নেই । আজ আমার স্বপ্ন ভাঙ্গার দিন। মনটা বারবার হু হু করে কেঁদে উঠছে। এবারো চাকুরী টা হলো নাহ ! বৃদ্ধ বাবা-মা আর রেহাই পেলো না তাদের নিত্যকার পরিবারের সব খরচের চক্রে । ছোট বোনটার বিয়ের কথা সব পাকা হয়ে আছে । আমার এই চাকুরীটা জুড়ে অনেক কিছুরই অপেক্ষা । কিন্তু আমি করব কি হবে এসব ভাবতেই বুঝি হৃদয় টা হিম হয়ে যাচ্ছে । একে একে সব বেদনার গল্প মাথা ফুসিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে । মনে হচ্ছে স্মৃতিস্মরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা । আবারো সেই অপরিচিত ঝাপসা গলার সুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল , “এই যে শুনুন , আপনার বয়স কত বলেন তো “?
একজন অপরিচিতার কাছে এরকম প্রশ্ন আমার নিকট নিতান্তই বিরক্তবোধ হল । মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে আর কিছুই বললাম না । আমার ইচ্ছে করছে কষে একটা চড় মেরে তাকে চুপ করে দেই। মুখটা ফিরানোর আগেই আবার সে বলে উঠল ,
” বয়সে তো বুড়ো হয়েছেন, তাহলে এরকম বাচ্চাদের মত কাদঁছেন কেন “?
এরকম প্রশ্নে আমি খানিকটা হকচকিয়ে উঠলাম , মাথা নিচু করে আছি । হাতটাও চায় না আর চোখের জল মুছে দিতে । যার স্বপ্ন চূড়ান্তভাবে ভাঙ্গে তারা লোকসম্মুখেও কাদঁতে লজ্জাবোধ করে না ।
আমার মনেই হচ্ছে না আমি একটা মেয়ের সামনে কাদঁছি ।
মেয়েটি এখন চুপচাপ আমিও অন্যদিকে তাকিয়ে আছি । খানিকটা শান্ত গলায়
আবার আওয়াজ এল, ” বৃষ্টি নতুন স্বপ্ন দেখায়, বৃষ্টি নতুন ভোর এনে দেয় “।
আমি কিছু বললাম না । এদিক বৃষ্টি বিরতিহীন ভাবে ঝরছে । স্টেশন এর যেখান থেকে শুরু ঠিক সেখানে পা ঝুলিয়ে বসে আছি । আর সাথে একটা অপরিচিত মেয়ে যাকে আমি চিনি না জানি না । কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি বলল , ” চলুন একটু হাটব “।
আমি তো হতবাক ! তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার চোখেমুখে অশেষ খুশির ছাপ। কি বলব কি না, তা ভাবার আগেই , ” বারে..! আপনাকে আমি কাগজ না ভিজতে উপকার করলাম আর আপনি সমান্য শুধু আমার সাথে হাটতে পারবেন না “?
মেয়েটিকে এতটাই চঞ্চল লাগছে যে এত বেদনার মাঝে কেন জানি শৈশবের খেলাধুলার ব্যকুলতা বেশ মনে পরছে । তার চোখে মুখে সারা দুনিয়ার সুখের ছায়া, নিষ্পাপ চাহনি ।
কিছু না বলে আমি প্লাটফরম এর নিচে নামলাম । হাটছি এক অপরিচিতার সাথে। ঝুম বৃষ্টির মাঝে দুই রেলপথ এর ব্যবধানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আর পাথরে ভর্তি এক নতু্ন রাস্তায়, চলছি ।
আমার মনে এখনো কান্নার শোরগোল, কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছি না । বৃষ্টির সময় বুঝি কষ্টেরা বেশী বেপরোয়া হয়ে ওঠে । জীবনে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেবটা যেন গলায় দড়ি দিয়ে কষতে শুরু করে তখন ।
মেয়েটি আবার পাশ থেকে বলল, ” আমিও কাদঁলাম, আপনার সাথে দেখা হবার ঠিক একটু আগে । কিন্তু এখন ভুলে গেছি । সবাই বলে হাসির পরে নাকি কান্না আর কান্নার পরে হাসি । সেটাই মানছি আর তাই সত্য । তবে আমি চাই বৃষ্টির সময়টা যেন হাসির এসে জুটে কেননা এসময়ের কান্নাটা সবচেয়ে গভীরতর হয় । তাই চাই না বৃষ্টির সময়টাতে কান্না এসে পড়ুক , বুঝেছেন “?
এটা বলে মেয়েটি চলতেই থাকল আমার জবাবের অপেক্ষা ছাড়াই । আমি দেখলাম মেয়েটির কাছে ছোট একটা ব্যাগ মাত্র , সেটাই অবাধে ভিজে যাচ্ছে । বলতে ইচ্ছে হল , না থাক..। হয়তো ভিজার মত তেমন কিছুই নেই । তাই এই উদাসীনতা ।
খানিকবাদে ফের একি সুর ভেসে আসল,
” আচ্ছা আপনার নাম কি ” ?
– অনন্ত ( আমি )
” তো মিস্টার অনন্ত, আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে কান্নার পরে আর হাসি হাসবেই না অনন্তই আপনি কাঁদবেন , এই হাসি-কান্নার চিরপ্রথা খন্ডন করবেন নাকি “?
আমি কি জবাব দিব খুঁজে পাচ্ছি না । ইতোমধ্যে অনুভব করলাম সে মুখ চেপে হাসবার চেষ্টা করছে । এবারো কিছু বললাম না । চিন্তার মহলজুড়ে তার উদ্ভট সব জিঙ্গাসার ফলে আমার কান্নায় বেশ ব্যাঘাত ঘটছে । একজন তরুণীর এরুপ আচরণ এই মূহুর্তে আমার কাছি নিতান্তপক্ষে বিরক্তিকর।
“এই যে রোবট, এত পিছনে কেন ব্যাটারি লো নাকি “? ( মেয়েটি চেঁচিয়ে )
এসব ভাবতে ভাবতে খানিকটা পিছিয়ে পরেছিলাম । কাছাকাছি যেতেই বলল – ” আপনার চশমা টা একটু দিবেন ? জানেন, আমার না চশমা পরার খুব শখ কিন্তু আমার চোখ দেখি সবসময় তাজা থাকে “।
মেয়েটিকে চশমা টা দিতে হাত বাড়াতেই
ছো মেরে নিয়ে ঝটপট চোখে লাগিয়ে নিল। একটু পরেই আওয়াজ , (ধপাস) ” ওরে মা রে,পা টা গেল রে “..!
আমি হাতটা এগিয়ে দিতে চাইলেও ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালাম । একজন পুরুষের নারীর প্রতি শ্রদ্ধা কতটুকু তা শুধু বৃষ্টিতে ভিজার সময় সত্যিকারে মাপা যায় । অতঃপর সে নিজেই উঠে বলল, ” যদি পা ভেঙ্গে যেত তখনও কি রোবট এর মত দাঁড়িয়ে থাকতেন নাকি “?
আমি কিছু বললাম না । দেখলাম সে চশমাটা হাতে নিয়ে বলছে ,”এই চশমা,তুই আমাকে আছাড় খাওয়া আর আচার খাওয়া যাই হোক । তোকে একদিন আমার নাকের ডগায় এনে বসাবই বসাব “।
আমার তার এই কান্ড দেখে একজন পাগল ছাড়া আর কারো কথা মনে পরছে না ।
তারপর আমাকে চশমাটা দিয়ে , ” এই যে মিস্টার চুপচাপ, আপনার গলায় কি আস্ত আনারস ঢুকে আছে নাকি হা করেন বের করে দেই “।
আমি বললাম ; আপনার সমস্যা টা কি ?
” সমস্যা এটাই যে আপনাকে আমার সাথে হাসতে হবে “। ( মেয়েটি )
হাসলে বিদেয় হবেন তো..? ( আমি )
উত্তর দিতে কাছে এসে শান্ত গলায় বলল, ” মিস্টার দামরা – বুড়ো , সেটা না হয় আপনার গোমরা মুখটা দেখে পরে বিচার করা যাবে, কেমন “?
আমি তো এরুপ আচরণে বেজায় রেগে গেলাম । চোখদুটো বড় বড় করে ভ্রূ কুচকে কিছু বলতে গেলে সাথে সাথে মেয়েটি বলে , ” আমার কয়টা দাঁত আছে গুনে দিবেন প্লিজ, না মানে আপনার চোখদুটো আস্ত ম্যাজিক বলের মত তো তাই “?
আমি সত্যি হেসে ফেলেছি । মেয়েটির এই অদ্ভূত আচরণে আমি অবশেষে হাসতে বাধ্য হলাম । আমার সমস্ত রাগ, কষ্ট বুঝি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল ।
আমার হাসির সাথে বিনা নিমন্ত্রণে নির্লজ্জের মত সেও হেসে যাচ্ছে । হাসবার সময় প্রতিটি মানুষ নির্লজ্জ হয়ে যায় । আর আমিও তাই , হাটুতে হাত রেখে আপনমনে হেসেই যাচ্ছি । সত্যি মনটা বদলে গেল এখন কেবল আমি পৃথিবীর একজন অতিথি মাত্র ।
হাসির পর্ব শেষ হলে দুজনে চুপচাপ, আমি ভাবছি মেয়েটা দেখছি আমাকে বোকা বানাল । সে যাই হোক আমার ভালো লেগেছে ।
” গান শুনবেন “?
সেই অপরিচিতার চির পরিচিত সুর এল কানে । আমিও
তৎক্ষনাৎ সায় দিলাম । সে দাঁড়িয়ে গেল, চোখদুটো বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল আর হাত দুটো ছাড়িয়ে দিয়ে –
” বাদল বেলা যদি বেদনায় কাঁদে মন,
থেকো না ঘরে তুমি –
এসেছে খুশির নিমন্ত্রণ ।
আঁখিজোড়া বুজে – হাসি ঠোঁটের মাঝে,
ছুঁয়ে দেখ তারে – হোক, সকাল আর সাঁঝে,
চঞ্চল হবে তোমার মন –
এসেছে খুশির নিমন্ত্রণ ।
বুকভরা কান্না আর ভাঙ্গা যত স্বপন,
জানি,হানা দেয় এসে মনে
বাদল আসে যখন ।
থেকো না সেবেলা – তুমি ঘরে একেলা,
ছুঁয়ে দেখ তারে -সাথে করো খেলা,
পুলকিত হবে তোমার মন –
এসেছে খুশির নিমন্ত্রণ “।
সে থেমে গেল কিন্তু আমি এখনো তার মতই তার পাশে তারি মতো কাকতাড়ুয়া হয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছি ।
সে যেন মনের কথা বলে। আমার সব হৃদয়ের কথা যেন তার গানে প্রতিধ্বনিত হল । তার গলার সুর যেন আমার কাছে অপূর্ব । এ এক গভীর তৃপ্ততায় আমায় অতৃপ্তি দিয়ে গেল ।
আমি পরের চরণ শুনতে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষারত এখনো আঁখিজোড়া বুজে রেখেছি ,
হঠাৎ সে বলল ,” কি বাঁচতে চান না “?
হ্যাঁ আমি বাঁচতে চাই। (আমি)
” তাহলে প্রত্যেক ভালো না লাগার মাঝে ভালো লাগা খুঁজে নিন, উপরওয়ালার প্রতি ভরসা রাখুন আর হ্যাঁ পরেরবার ইনটারভিউ তে অবশ্যই হাসিমুখটা রাখবেন , কেমন “?
বলেই চুপ হয়ে গেল ।
আমি চোখ খুলে দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে আমার আরেকবার চোখের পলক পড়া মাত্রই তার হাটার উপক্রম, আমি কেমন জানি অবলার মত বললাম; কোথায় যাচ্ছেন?
” আমায় যেতে হবে ” বলেই মুখে সেই স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে দ্রুত পদে হাটার শুরু করল । বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেল
আমি হতভম্ব হয়ে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে চিৎকার করে অধিকারবোধে অধিকার নিয়ে বললাম ;
তোমার দেখা আর কবে পাবো ?
প্রতিউত্তরে সে আমার দিকে ফিরে সেই অপূর্ব হাসি নিয়ে বলে ,
” আমার দেখা যদি তুমি পেতে চাও আবার ,
বৃষ্টি এলে তবে ভিজো বারেবার “।
ধীরে ধীরে বৃষ্টির কুয়াশায় সে মিলিয়ে গেল আমি নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।
আজো দাঁড়িয়ে আছি চার বছর হলো এই ষ্টেশনেই আছি, নাম না জানা সেই নারীর প্রতিক্ষায় । সেই হাসিমুখ আর ভরসা নিয়ে পরেরবার আমার চাকুরী টা হয়ে গেছে আর সেই হাসিমুখ নিয়েই জীবনের সব সব সামলে নিয়েছি ।
যখনি বৃষ্টি আসে আমি তখনি এখানে ছুটে আসি। জানি না কি নাম তার, কি তার ঠিকানা। আমি কিছুই জানি না , শুধু জানি সেই কথা ; “আমার দেখা যদি তুমি পেতে চাও আবার , বৃষ্টি এলে তবে ভিজো বারেবার “।
আমিও তাই ভিজতে একটুও বিলম্ব করি না । বাকি গানের অংশটুকু শোনার জন্য আমি আজো প্রতিক্ষায় । আরেক বৃষ্টিতে আরেক নতুন ভোরের সূচনা হোক, নতুন স্বপ্ন ধরা দিক । আমি শুধু একটাই কথা জানি , ” সেদিন দেখা হয়েছিল , আবার দেখা হবে “।
মন্তব্য করুন