কয়দিন পর আমরা শহর ছেড়ে চলে গেলাম। প্রথমে গেল ফজলুরা। একেবারে হঠাৎ করে চলে গেল, যাবার আগে আমাদের সাথে দেখাও করে যেতে পারেনি। তারপর গেল আশরাফরা। তার আব্বা সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে গেলেন। ঢাকা শহর নাকি এখন সবচেয়ে নিরাপদ।
তারপর আমাদের যাবার দিন এসে গেল। দুটি নৌকা ঠিক করা হয়েছে, নৌকা করে আমরা এবং অরু আপারা গ্রামের ভিতরে চলে যাব।
যাবার আগের দিন আমি খুব কষ্ট করে রাশেদের সাথে দেখা করতে গেলাম। শহরে খবর ছড়িয়ে গেছে ছোট ছোট ছেলেরা মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করছে, তাই আব্বা আর আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেন না।
রাশেদ যখন শুনল আমিও চলে যাচ্ছি তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, “সত্যি চলে যাচ্ছিস ?”
“হ্যাঁ। আব্বা আর থাকতে চাইছেন না। মিলিটারি ক্যাম্পের এত কাছে থাকা খুব নাকি ভয়ের ব্যাপার।”
রাশেদ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমাকে তাহলে সব একা একা করতে হবে!”
“কি করবি একা?”
“পারমিশান নাই”- বলেই রাশেদ হেসে ফেলল। বলল “তোকে বলতে কোনো দোষ নেই! তুই আর আমি তো একই।”
তারপর গলা নামিয়ে বলল, “নদীর উপরে যে ব্রিজটা আছে সেটা ওড়াব। ফ্রগম্যান এসেছে, সাথে লিমপেট মাইন।”
“ফ্রগম্যান?”
“হ্যাঁ, পায়ে ব্যাঙের পায়ের মতো ফ্লপার লাগিয়ে নদীতে সাঁতরে সাঁতরে যায়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“দিন-তারিখও ঠিক করা আছে কিন্তু সেটা এখনো কেউ জানে না। একটা যুদ্ধ হবে কমলগঞ্জে। অনেক বড় যুদ্ধ। তখন একটা পাকাপাকি ফ্রন্ট খুলবে এখানে। তার আগে আগে যেন কোনো সাপ্লাই যেতে না পারে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কি বলেছি জানিস?”
“কী?”
“ব্রিজটা আগেই না ওড়াতে। ঠিক যখন একটা মিলিটারি ট্রেন ব্রিজের উপরে থাকবে তখন ‘বুম’!” রাশেদ দুই হাত দিয়ে আমার চোখের সামনে ব্রিজটা উড়িয়ে দিলো।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, “কেমন করে জানবি কোনটা মিলিটারি ট্রেন? ভুল করে যদি প্যাসেঞ্জার ট্রেন উড়িয়ে দেয়-”
“না না, সেটা তো করাই যাবে না।” রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, “ধর কমলগঞ্জে যুদ্ধ শুরু হলো। তখন একটা ট্রেন বোঝাই করে মিলিটারি গোলা-বারুদ তো ওদিকে যাবেই। তখন ধর আমরা কেউ যদি স্টেশনে থাকি, যখন দেখব ট্রেনটা ছাড়ছে, খবর পাঠিয়ে দিলাম, ঠিক যখন ব্রিজের উপর আসবে- ‘বুম’!” রাশেদ আবার ব্রিজটা উড়িয়ে দিলো।
“কেমন করে খবর পাঠাবি?”
“সেটা এখনো ঠিক করিনি। দিনের বেলা হলে আয়না দিয়ে-”
যদি মেঘলা দিন হয়?”
রাশেদ একটু হেসে বলল, ‘সেটা ভেবে একটা কিছু উপায় বের করে ফেলব! মনে নাই শফিক ভাইকে কেমন করে উদ্ধার করলাম!”
ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় আমরা দুজনেই একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে হাসতে থাকি। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “শফিক ভাই কেমন আছে এখন?”
“ভালো, এতদিনে বর্ডারের কাছে পৌঁছে গেছেন। হাসপাতালে থাকার সাহস পেলেন না। পরদিন ভোরেই একটা রিকশা নিয়ে বের হয়ে গেলেন, সবার সামনে দিয়ে!”
আমি আর রাশেদ আবার আনন্দে হাসতে থাকি। রাশেদ হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “তুই থাকলে খুব ভালো হতো। সবাই চলে যাচ্ছে, আমি একা হয়ে গেলাম।”
রাশেদ একটা নিশ্বাস ফেলে কেমন জানি একটা দুঃখী-দুঃখী মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কি করব বল? ছোট হলে বড়ো অসুবিধে, সবসময় বড়দের কথা শুনতে হয়।”
“তা ঠিক।”
আমি আর রাশেদ আরো অনেকক্ষণ কথা বললাম, দুজনে হেঁটে হেঁটে গেলাম রাস্তা দিয়ে তারপর আবার ফিরে এলাম।
রাশেদ তখন আমাকে চায়ের দোকানে নিয়ে মালাই দিয়ে চা খাওয়াল। ফিরে আসার সময় রাশেদ হঠাৎ আমার হাত ধরে একটু ইতস্তত করে বলল, “তুই আমার বন্ধু হবি?”
“একেবারে প্রাণের বন্ধু। সারা জীবনের বন্ধু। মরে গেলেও যে বন্ধু থেকে যায়, সেই বন্ধু। হবি?”
আমি মাথা নাড়লাম, “হব।”
রাশেদ তখন খুশি হয়ে একটু হাসল। ফিসফিস করে বলল, “আমার কোন প্রাণের বন্ধু নাই-মানে আগে ছিল না। একজন বন্ধু খুব দরকার, যাকে সবকিছু বলা যায়।”
“সবকিছু কী?”
“কত কী বলা যায়! তুই কি আমার কিছু জানিস? আমি কে? আমার বাব কী? কী করে? কিছু জানিস?”
আমি মাথা নাড়লাম, “না, জানি না।”
মাঝে মাঝে আমার কৌতূহল হয়েছে সত্যি কিন্তু কখনো রাশেদকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।
রাশেদ একটু হেসে বলল, “তুই যখন আমার প্রাণের বন্ধু হলি তোকে কোন একদিন সবকিছু বলব।
আজকাল শুধু ভয় হয়, যেকোনো দিন কেউ আমরা মরে যাব।”
“তা ঠিক।”
রাশেদ হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি আমি কোনোদিন মরে যাই, তুই আমার কথা মনে রাখবি?”
রাশেদ কেন এটা বলল আমি জানি না কিন্তু আমার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল, আমি রাশেদের হাত ধরে বললাম, “দূর বেকুব কোথাকার! তুই মরবি কেন?”
রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, মরার কথা বলা ঠিক না।”
আমরা কত ছোট কিন্তু আমাদের কিনা এখনই মরে যাওয়া বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবতে হয়!
আর.ডিবিএস
মন্তব্য করুন